আমরা জানি যে, প্রতিটি অধিকারের সাথে দায়িত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং অধিকার সম্বন্ধে কিছু বলতে হলে মানবিক মর্যাদা, ন্যায্যতা ও দায়িত্বের সাথে তার সম্পর্ক বিবেচনা করতে হবে। বাইবেলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা সমান। তবে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়মের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। পুরাতন নিয়মে অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারেনি। কিন্তু নতুন নিয়মে নারীর সমান অধিকার স্বীকৃত। এর কারণ, নতুন নিয়ম হচ্ছে পুরাতন নিয়মের পূর্ণতা। তাই সেই প্রেক্ষাপটেই নারীর অধিকার সম্বন্ধে আমার এই উপস্থাপনা।
পুরাতন নিয়মে নারীর
১। ব্যক্তি মর্যাদা: ঈশ্বর মানুষকে নর ও নারী করে সৃষ্টি করেছেন। তাই নারী ও পুরুষের মানবিক মর্যাদা সমান। তাই তাদের অধিকারও সমান। এই মর্যাদার স্বীকৃতি পাওয়া নারীর অধিকার। তিনি তাদেরকে পরস্পরের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। বাইবেলের ভাষায় নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। নারী-পুরুষের মর্যাদা সমান বলেই স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক, পরস্পরের সঙ্গী-সঙ্গিনী। আদি পুস্তকের বর্ণনা অনুযায়ী হবাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদমের পাঁজর থেকে। ঈশ্বর বলেছেন, মানুষের পক্ষে একা থাকা ভালো নয়, এজন্যই আদমের সঙ্গিনী হিসেবে হবাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। হবাকে দেখে আদম বলে উঠলেন : ‘‘এ আমার অস্থির অস্থি, মাংসের মাংস।’’
২।পুরাতন নিয়মে নারীদেরকে পুরুষের অধীনেই থাকতে হতো: পরিবারে তারা থাকতো পিতার অধীন বা স্বামীর অধীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের মর্যাদা পুরুষের চাইতে নিচে বলে মনে করা হতো। সমাজে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ সাধারণ পুরুষই হতেন। আদি পুস্তকে কুলপতি হিসেবে পুরুষের নামই দেখা যায় : নোহ, আব্রাহাম, ইসহাক, যাকোব, যোসেফ ইত্যাদি। ঈশ্বরের নির্দেশে মোশী ৭০ জন পুরুষকে নেতা হিসেবে মনোনীত করে তাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ : রানী এস্থার। পারস্যরাজের স্ত্রী হিসেবে তিনি মন্ত্রী হামানের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে ইসরাইল জাতিকে রক্ষা করেছিলেন।
৩। পুরাতন নিয়মে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল তার পিতৃগৃহে অথবা পতিগৃহে। তাদের প্রধান কাজ ছিল গৃহস্থালী করা, বাড়ি-ঘরের দেখাশুনা করা এবং স্বামী ও সন্তানদের যত্ন নেয়া। নারীরা আদালতে বিচারের সময় সাক্ষ্য দিতে পারতেন না, কারণ ঘরের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকার কারণে বাইরের ঘটনাবলী সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে অবগত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল। উদাহরণস্বরূপ : লাপ্পিদোতের স্ত্রী দেবোরা ছিলেন একজন বিচারক ও নবী। বারাকের সাথে তিনি দশ হাজার সৈন্যকে সংগঠিত করে বিদেশী অত্যাচারী রাজা যাবিনকে যুদ্ধে পরাজিত করে ইসরাইল জাতিকে রক্ষা করেছিলেন (#বিচারকচরিত ৪, ৫, ৬)। যুদ্ধে জয়লাভ করার পর তিনি প্রভু পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশংসাগীত গেয়েছিলেন (ঐ ৫ অধ্যায়)।
৪। সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। কোনো অবিবাহিত মেয়ে গর্ভবতী হলে বা ব্যভিচারের কাজে ধরা পড়লে পুরুষকে পাপের পথে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। সাধারণত পাথর ছুঁড়েই তাকে মারা হতো। পুরুষের চাইতে নারীকেই অনেকগুণে বেশি শাস্তি দেয়া হতো।
৫। পুরাতন নিয়মে আবার ‘‘সদাপ্রভুর দীনজনদের’’ প্রতি বিশেষ দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ ছিল। তার মধ্যে বিধবাদের প্রতি সমাজের কর্তব্য পালনের বিধান ছিল। ‘‘তোমরা কোনো বিধবা বা কোনো এতিমের প্রতি দুর্ব্যবহার করবে না’’ (#যাত্রা পুস্তক ২২:২২)। ‘‘বিধবার কাপড় বন্ধক রাখবে না’’ (দ্বিঃবিঃ ২৪:১৭); ‘‘অভিশপ্ত সেই মানুষ, যে বিদেশী, এতিম ও বিধবার অধিকার লঙ্ঘন করে’’ (ঐ ২৭:১৯); ‘‘.... এতিমের সুবিচার কর, বিধবার পক্ষ সমর্থন কর’’ (#ইসাইয়া ১:১৭)।
৬। গুণবতী নারীদের প্রশংসা: ‘‘গুণবতী নারী-তাকে কে পেতে পারে? মণিমুক্তার চেয়েও তার মূল্য অনেক বেশি। ... সে প্রজ্ঞার সঙ্গে মুখ খোলে, তার জিহবায় সহৃদয় নির্দেশবাণী উপস্থিত’’ (#প্রবচন ৩১:১০, ২৬)।
৭। পুরাতন নিয়মে অনেক নারী মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ : মিসররাজ ফারাওর আজ্ঞা ‘‘মেনে না নিয়ে মিসরীয় ধাত্রীরা বরং ছেলেদের বাঁচতে দিত’’ (#যাত্রা ১:১৭)। জন্মের মুহূর্তেই হিব্রীয় পুরুষ সন্তানদের মেরে ফেলার আদেশ বহাল থাকলেও স্বয়ং ফারাওর কন্যাই, শিশু মোশীকে নীল নদে ভাসমান ঝাঁপি থেকে উদ্ধার করে আপন সন্তান হিসেবে লালন-পালন করেছিলেন।
নতুন নিয়ম
নতুন নিয়ম ও খ্রিষ্টমন্ডলীর শিক্ষা নারীর মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। যিশুখ্রিষ্টের ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ও শিক্ষায় সেই পার্থক্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মন্ডলী ক্রমাগত ঐশবাণী ধ্যান ও ব্যাখ্যা করে সেই শিক্ষাকে বিস্তার করতে সচেষ্ট।
১। মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষের ব্যক্তি মর্যাদা সমান। তাই তাদের অধিকারও সমান। খ্রিষ্টমন্ডলীর শিক্ষা অনুযায়ী মানুষের জন্মগত মৌলিক মানবাধিকারগুলো : খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিশ্রাম, চিকিৎসা ও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা পাবার অধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষ বা নারীর মধ্যে কোনো প্রভেদ বা পার্থক্য নেই।
২। যিশুখ্রিস্ট নারী-পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য করেননি। যে-স্ত্রীলোকটি আঠারো বছর ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, কুঁজো হয়ে চলাফেরা করেছে, তাকে তিনি ‘আব্রাহামের কন্যা' বলেছেন। তিনি তাকে ঈশ্বরের সন্তান হিসাবে সমান মানসিক মর্যাদা দিয়েছেন। বিশ্রামবারে তিনি তাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন।
৩। ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত যে স্ত্রীলোকটিকে ফরাসীরা ধরে নিয়ে যিশুর কাছে এসেছিলেন এবং মোশীর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন, তাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদেরকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার মধ্যে যিনি নিাপ, তিনিই প্রথমে একে পাথর ছুঁড়ে মারুন' (#যোহন ৮:৭)। যিশু হয়তো বলতে পারতেন, ব্যভিচার করে তো দু'জনে মিলে। তবে পুরুষ লোকটি কোথায়? পাপের ভাগী তো দু'জনেই, দায়িত্ব তো দু'জনেরই। কিন্তু অভিযুক্ত মেয়েটির প্রতি যিশুর ক্ষমা ও প্রেমপূর্ণ আচরণ তার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাই তিনি তাকে বললেন, ‘‘আমিও তোমাকে দন্ডিত করব না। এবার যাও; এখন থেকে আর পাপ করো না’’ (ঐ ৮:১১)। মানবিক মর্যাদার স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধাবোধ ও স্বীকৃতিই সেই স্ত্রীলোকটির জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।
৪। যিশুর শিক্ষায় বিধবাদের প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘‘শাস্ত্রীদের বিষয়ে সাবধান: তাঁরা লম্বা লম্বা পোশাকে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন এবং হাট-বাজারে শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিবাদন, সমাজগৃহে প্রধান আসন ও ভোজসভায় প্রধান স্থান পেতে ভালবাসেন। তাঁরা বিধবাদের বিষয়-সম্পত্তি গ্রাস করেন, আর ভান করে লম্বা লম্বা প্রার্থনা করেন-- এঁরা বিচারের গুরুতর শাস্তি পাবেন।’’ (#লুক ২০:৪৫-৪৭) ‘‘ধনীরা মন্দিরের কোষাগারের বাক্সে তাদের প্রণামী দিয়ে যাচ্ছিল। একটি গরিব বিধবা সেই বাক্সে দুটো ক্ষুদ্র মুদ্রা দিল। তখন যিশু তাঁর শিষ্যদের বললেন, ‘‘আমি তোমাদের সত্যি বলছি, সকলের চেয়ে এই গরিব বিধবাই বেশি দিল; কেননা এরা সকলে প্রণামীর বাক্সে নিজ নিজ বাড়তি ধন-সম্পদ থেকে কিছু কিছু দিয়েছেন, কিন্তু সে নিজের চরম দরিদ্রতায় তার যা কিছু ছিল, তার জীবন সর্বস্বই দিয়ে দিল’’ (ঐ ২১:১-৪)
৫। যিশু ইহুদী সমাজে প্রচলিত পুরুষকেন্দ্রিক বিবাহ-বন্ধন ও বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাক প্রথার ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিলেন। ইহুদী বিধানমতে ‘মোশী ত্যাগপত্র লিখতে ও নিজ স্ত্রীকে ত্যাগ করতে অনুমতি দিয়েছেন।’’ যিশু তাঁদের বললেন, ‘আপনাদের হৃদয় কঠিন ছিল বলেই তিনি এ বিধি লিখেছিলেন, কিন্তু সৃষ্টির আদি থেকে ঈশ্বর পুরুষ ও নারী করে তাদের গড়লেন, এই কারণে পিতা ও মাতাকে ত্যাগ করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবে এবং সেই দু'জন একদেহ হবে; সুতরাং তারা আর দু'জন নয়, কিন্তু একদেহ। অতএব ঈশ্বর যা সংযুক্ত করেছেন, মানুষ তা যেন বিযুক্ত না করে। পরে শিষ্যদের তিনি বললেন, ‘‘যে কেউ নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য একজনকে বিবাহ করে, সে তার বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে; এবং কোন স্ত্রীলোক যদি নিজের স্বামীকে ত্যাগ করে অন্য একজনকে বিবাহ করে, সেও ব্যভিচার করে' (#মার্ক ১০:৪-১২)। যেহেতু নারী-পুরুষ উভয়ে সমমানের নৈতিক ব্যক্তি, সেহেতু নীতি-নৈতিকতার দায়-দায়িত্ব নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।
৬। ইহুদী সমাজে অপরিচিত নারীদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু যিশু যাকোবের কুয়োর ধারে একজন শমরীয় স্ত্রীলোকের সাথে কথা বলেছেন এবং তা দেখে তাঁর শিষ্যরা বিস্মিত হয়েছিলেন। যিশু কিন্তু অনৈতিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত স্ত্রীলোকটির প্রতি বিশেষ দয়া করার ফলে সে হয়ে উঠল সুখবরের বাহক। সে গিয়ে তার শহরবাসীদের কাছে এই সুখবর ছড়িয়ে দিল।
৭। যিশু আচারগত অশুচিতার বিধান উপেক্ষা করেছেন। রক্তস্রাবে আক্রান্ত একজন স্ত্রীলোক সুস্থ হওয়ার আশায় ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে তাঁর পোশাক স্পর্শ করল। কিন্তু ভয়ে কম্পমান স্ত্রীলোকটিকে যিশু অভয় দিয়ে বললেন, ‘‘কন্যা, তোমার বিশ্বাস তোমার পরিত্রাণ সাধন করেছে; শান্তিতে যাও, ও তোমার রোগ থেকে মুক্ত হয়ে থাক।’’ (#মার্ক ৫:২৫-৩৪)
৮। যিশু নারীদেরকে তাঁর শিষ্যদলের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন। বারোজন প্রেরিত দূতের পাশাপাশি অনেক স্ত্রীলোকও তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন এবং তাঁর ও তাঁর শিষ্যদের সেবাযত্ন করেছিলেন। (#লুক ৮:১-৩)। ক্রুশের নিচে প্রেরিত শিষ্য যোহনের সাথে তাঁরাও উপস্থিত ছিলেন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিশ্বস্তভাবে যিশুর অনুসরণ করেছিলেন। (#মথি ২৭:৫৫; #মার্ক ১৫:৪০; #যোহন ১৯:২৫)।
৯। যিশুর পুনরুত্থানের সংবাদ প্রথমে স্ত্রীলোকেরাই জানতে পেরেছিলেন। (#মথি ২৮:৭)। একজন স্বর্গদূত মা ালার মারীয়াকে ও অন্য মারীয়াকে বললেন, ‘‘তোমরা শীঘ্রই গিয়ে তার শিষ্যদের বল যে, তিনি মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থান করেছেন’’
১০। আদি খ্রিস্টমন্ডলীতে নেতৃবর্গের মধ্যে অনেক স্ত্রীলোক ছিলেন। সেন্ট পলের লেখায় নেতৃত্বের ভূমিকায় অনেক নারীদের নাম পাওয়া যায় যাঁরা জনগণের সেবায় জীবন নিবেদন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ: ফৈবে, প্রিস্কা, আকুইলা, মারীয়া, ত্রিফাইনা, ত্রিফোসা, জুলিয়া ইত্যাদি (#রোমীয় ১৬)। তবে সেন্ট পল তার সমকালীন সমাজের কৃষ্টিগত ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই বিবাহিত স্ত্রীলোকদের তিনি স্বামীর অধীনতা স্বীকার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ধর্মশিক্ষায় তিনি নারী-পুরুষের সমমর্যাদার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই তিনি বলেন, ‘‘যারা দীক্ষাস্নানে খ্রিস্টের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তারা সকলেই নববেশ-রূপে পরিধান করেছ স্বয়ং খ্রিস্টকে। তাই, তোমাদের মধ্যে এখন পুরুষও নেই, নারীও নেই’’ (#গালাতীয় ৩:২৮)। তারা সবাই হয়ে ওঠে ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই।
১১। সম্পত্তির উপর স্ত্রী ও কন্যাদের অধিকার: খৃস্টমন্ডলীর আইন অনুযায়ী স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পায় সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পুত্র-কন্যারা সমান ভাগে পায়। অর্থাৎ পুত্র-সন্তান যতটুকু পায়, কন্যা সন্তানেরও ততটুকুই প্রাপ্য।
১২। ঈশ্বরের দশ-আজ্ঞার চতুর্থ আজ্ঞা: ‘‘তোমার পিতামাতাকে সম্মান কর’’ কারণ তারা ঈশ্বরেরই প্রতিনিধি। তারা সন্তানদের জন্মদাতা, মানবসমাজে তারাই সন্তানদের এনেছেন। ঈশ্বরের পরেই পিতামাতার স্থান। পিতামাতাকে সম্মান করা মানে ঈশ্বরকেই সম্মান করার তুল্য। ‘‘সম্মান’’ পারিবারিক অধিকার সংরক্ষক। ভালবাসা ও সম্মান করা উভয়ই গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সম্মান হল ন্যায্যতার সাথে সংযুক্ত। ভালবাসা ছাড়া ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বাইবেলে আছে, তোমার ঈশ্বর ও প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালবাসবে। পিতামাতা, সন্তান ও পারিবারিক সদস্য-সদস্যা ছাড়া কে অধিকতর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হতে পারে? সম্মান হল পিতামাতার নিকট সন্তানদের কৃতজ্ঞতার উপহার। সম্মান সব সময়ই উপকারমুখী। মানুষের সমস্ত অধিকার, আইন-কানুন নিষ্ফল হবে যদি তারা একে অন্যকে সম্মান না করে। ‘‘অভিশপ্ত সেই মানুষ, যে নিজের পিতা বা মাতাকে তুচ্ছ করে’’ (দ্বিঃবিঃ ২৭ : ১৬)। ‘‘সন্তান আমার, তোমার পিতার আজ্ঞা পালন কর, তোমার মাতার নির্দেশবাণী অবজ্ঞা করো না’’ (#প্রবচন ৬ : ২০)।
১৩। পরিবারে ভাইবোনের মধ্যে পারস্পরিক অধিকার: লাজারের বোন ছিলেন মার্থা ও মেরী। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মধুর। যিশু তাদের পরিবারে গিয়ে তাদের আতিথ্য গ্রহণ করতেন। মার্থা বেশি মনোযোগী ছিলেন খাদ্য পরিবেশনার বিষয় নিয়ে, আর মারীয়া ধ্যানমগ্ন হয়ে যিশুর কথা শুনতেন।
১৪। পরিবারে স্ত্রীর ভূমিকায় অধিকার: ঈশ্বরের পরিকল্পনায় পরিবার হলো ‘‘মানুষ’’ হবার প্রথম বিদ্যালয়। প্রতিটি পরিবারের কর্তব্য হলো মানুষ তৈরি করা যারা পরিবার, সমাজ, দেশের তথা বিশ্বের নাগরিক হবে। ঈশ্বরের কাছ থেকেই সকল পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব এসেছে; তিনিই সমস্ত সৃষ্টির উৎস, তার কাছ থেকেই এসেছে মানব পরিবার (#এফেসীয় ৩ : ১৪-১৫)।
১৫। সন্তানের মা হিসাবে অধিকার: সন্তানেরা পিতামাতার ভালবাসার দাবীদার মাতৃগর্ভে আসার মুহূর্ত থেকেই। সন্তানদের লালন-পালন পিতামাতা উভয়েরই দায়িত্ব। কিন্তু গর্ভধারণের প্রথম মাসগুলোতে মা ও শিশুর মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কেবল সন্তানই মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং মা-ও সন্তানের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ পারস্পরিক প্রভাব আরও বেশি প্রকাশ পায় সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর। গর্ভাবস্থায় বাবাও তার স্ত্রীকে নৈতিক, দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
১৬। বিধবাদের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেয়ার বিধান: ‘‘যারা প্রকৃতভাবেই বিধবা, তাদের প্রতি চিন্তাশীল হও’’ (#১তিমথি ৫ : ৩)। শিষ্যচরিত গ্রন্থে গ্রীকভাষী ইহুদীরা ‘‘দৈনিক সাহায্যদানে তাদের বিধবাদের অবহেলা করা হচ্ছিল’’ (৬ : ১) বলে অভিযোগ তুললে প্রেরিত শিষ্যগণ সভা ডেকে আলোচনা করে সাহায্যদানের কাজ করার জন্য সাতজন ডিকনকে মনোনীত করেন। সাধু যাকোব বলেন; ‘‘আমাদের পিতা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে শুদ্ধ ও নিষ্কলঙ্ক ধর্মাচরণ হলো এই: এতিম ও বিধবাদের দুঃখকষ্টের দিনে তাদের সহায়তা করা এবং সংসারের কলুষ থেকে নিজেকে অকলুষিত রাখা’’ (১:২৭)।
১৭। পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে শিক্ষা: খৃস্টমন্ডলীর ঐতিহ্যধারায় পরিবারকে ‘‘গৃহমন্ডলী’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভালবাসার সভ্যতা হচ্ছে পারিবারিক জীবনে এক সাথে বসবাস করা, একে অন্যের জন্য কাজ করা, পরস্পরকে ভালবাসা এবং পরস্পরের ব্যক্তিমর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া। ঈশ্বর সবাইকেই সমানভাবে ভালবাসেন (#লুক ২০:৩৮)। বাবা-মা একত্রে নবজাত সন্তানদের পরিপক্ক মানবিক শিক্ষা দেয়। সন্তানকে দৈহিক, মানসিক, মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা পিতামাতার দায়িত্ব ও অধিকার। যিশুর জীবনে তার মা মরিয়মের ভূমিকা সম্বন্ধে বিস্তারিত অনেক কিছুই লেখা আছে। শৈশবে ও বাল্যকালে যিশু তার পালক পিতা যোসেফ ও মাতা মারীয়ার প্রতি বাধ্য থেকেই বয়সে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে জ্ঞানে এবং ঈশ্বর ও মানুষের ভালবাসায় বেড়ে উঠেছিলেন। (#লুক ২:৫১-৫২) বর্তমান বাস্তবতা পাপময় জগতে আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান অনস্বীকার্য। আদর্শ হচ্ছে লক্ষ্য, যা বাস্তবায়নের জন্য সাধনার প্রয়োজন। সচেতন চেষ্টা বা সাধনা ছাড়া এ জগতে উত্তম কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। শাস্ত্রবাণী বা শাস্ত্রের বিধি-বিধানগুলো যদি সঠিকভাবে পালন করা হতো তা হলে তো পৃথিবীটা আসলেই ভূস্বর্গে পরিণত হতো। নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ অর্জন, দায়িত্ব পালন ও সম্মান প্রদর্শন- এগুলো অর্জন সাপেক্ষ।
১৮। সমাজে নারীর মর্যাদা: কাগজে-কলমে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তব জীবনে তার অনেক ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। নারী-পুরুষের মধ্যে আজো অনেক বৈষম্য বিদ্যমান; শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনের অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান।
১৯। পরিবারে পুরুষ-সন্তান ও কন্যা-সন্তানের মধ্যে বৈষম্য: পরিবারে কন্যা-শিশুরাও তো একই পিতামাতারই সন্তান। তথাপি পুরুষ-শাসিত সমাজে অনেক পরিবারে ছেলে-সন্তানের প্রতি পিতামাতার পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। পুরুষ সন্তানকে পরিবারের সম্পদ হিসেবে দেখা হয়, আর কন্যা-সন্তানকে দায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে এই মনস্তত্ত্ব কাজ করে যে, পুরুষ সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে বড় করে তুললে সে পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করবে। কিন্তু কন্যা-শিশু তো বয়স হলে বিয়ে হয়ে অন্যের ঘরে চলে যাবে। সুতরাং তাদেরকে শিক্ষিত করার জন্যে টাকা খরচ করে লাভ কী?
২০। নারী নির্যাতন: ছেলে ও যুবকদের উৎপাত, বখাটেপনা ও উত্যক্ততার শিকার অসংখ্য কন্যাশিশু, বালিকা ও ছাত্রী। স্কুলে যেতে-আসতে রাস্তাঘাটে বা রিকশা-বাসে চলার সময় মাত্রাতিরিক্ত উত্যক্ততার কারণে ঘরে এসে মনখুলে মা-বাবা বা গুরুজনদের কাছে বলার সাহসের অভাবহেতু অনেক মেয়ে-শিশু ও কিশোরীদের অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়। অনেক সময় অভিভাবক বা পিতামাতা কিছু শুনতে বা জানতে পারলে দোষী বখাটে ছেলেদের বিরুদ্ধে কিছু না বলে বরং উল্টো মেয়েটিকেই দোষারোপ করেন। তার কারণ হয়তো এই যে, ছেলের বাবা বিত্তবান বা প্রভাবশালী। ফলে মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ধর্ষণের শিকার হয় অনেক অবলা-অসহায় মহিলা, অনেকে নারী-শিশু পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে মান-সম্মান ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের আশা হারিয়ে ফেলে, মেয়েদের সম্বন্ধে মিথ্যা রটনা নিয়ে মা-বাবা বা অভিভাবক চিন্তিত হয়ে পড়েন। মান-সম্মান রক্ষা করে বলার খাতিরে তারা মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। বাল্যবিবাহ দেয়ার পেছনে পিতামাতার মনে এক ধরনের টেনশন কাজ করে। গৃহপরিচারিকা বা কাজের মেয়ের প্রতিও অনেক সময় অনেক অমানবিক আচরণ করা হয়, যার কিছুটা মাঝেমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
২১। যৌতুক প্রথা: বিয়ের সময় ছেলেপক্ষ থেকে মেয়ে-পক্ষের কাছে যৌতুক দাবি করা হয়। মেয়ের পিতামাতা যৌতুক দিতে অপারগ হলে বিয়ের পর স্ত্রীর উপর নির্যাতন শুরু হয়, স্ত্রীকে তার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অনেক সময় বাবা-মায়ের সেই যৌতুক দেয়ার সামর্থ্য না থাকার কারণে নববধূ মানসিকভাবে অনেক কষ্টের শিকার হয় এবং মাঝে মাঝে সেই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তারা আত্মহত্যার আশ্রয় নেয়। এসিড নিক্ষেপের ফলে একটি মেয়ে সারা জীবনের জন্য বিকৃত মুখচ্ছবি নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয় অথবা মনোবল হারিয়ে আত্মহত্যার আশ্রয় নেয়।
২২। বিধবারা, বিশেষ করে গরীব বিধবারা সমাজের অনেক অন্যায়-অন্যায্যতার শিকার হয়। সাবালক ছেলে ঘরে না থাকলে বেঁচে থাকার তাগিদে তাদেরকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। তদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার সুযোগ গ্রহণ করে বিত্তবান অথবা কামুক পুরুষ যুবতী বিধবাদের হেনস্তা করে।
২৩। গ্রাম্য বিচার ও সালিশের সময় সাধারণত নারীর বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়। ব্যভিচারের অভিযোগ উঠলে সমাজের মাতববর-মুরুবিবগণ শুধু মেয়েটিকেই দোষারোপ করে শাস্তির বিধান দেন। কিন্তু একই অন্যায় কাজে সমদোষী ছেলেটির টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে তাদের সাহস হয় না।
বর্তমানে অবশ্য নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। নারীর অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন ও বিবরণে যেসব চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। এরূপ পরিস্থিতির প্রতিকার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পারিবারিক বা দাম্পত্য বন্ধনের গুরত্ব সবারই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অপরকে সম্মান দিতে না শিখলে আমরা নিজেরাও সম্মানিত হতে পারি না। জীবনের মৌলিক শিক্ষা হয় পরিবারে। সেখানে যদি স্বামী-স্ত্রী বা পিতামাতার মধ্যে পারিবারিক জীবনের সুস্থ ও সুন্দর আদর্শ গড়ে ওঠে তবে সন্তানেরা তাকেই অনুসরণ করবে। ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে বিবেকবোধ জাগ্রত করার মোক্ষম স্থান হচ্ছে পরিবার। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব না করে মা-বাবাকে কন্যাশিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। ছেলে বা মেয়ে- উভয়েই পিতামাতার ভালবাসার ফসল, বিবাহিত নারী-পুরুষের নিকট স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ দান। তাই তাদের প্রতি পিতামাতার অকৃত্রিম ভালবাসা থাকতে হবে, তাদেরকে যত্ন সহকারে লালন-পালন করতে হবে। ব্যক্তি বা মানুষ হিসাবে মর্যাদা দিতে হবে। আইনের শাসন, বিচার ও শাস্তির ভয় ইত্যাদি ব্যবস্থা সাময়িকভাবে প্রয়োজন হলেও তা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। মানুষের মধ্যে অশুভ পাশবিক শক্তিকে দমন বা নির্মূল করতে হলে শুভ শক্তি বা চৈতন্য জাগ্রত করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব জীবনে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে তাকে তার যোগ্য আসনে বসাতে হবে। কেননা, যেসব শিশু, বালিকা, তরুণী, যুবতী বা স্ত্রীলোক নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তারা তো একই মানব-পরিবারের সদস্যা, আমার-আপনারই সন্তান, বোন, স্ত্রী বা মা। সুতরাং তাদেরকে সেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারলেই সমাজে প্রকৃত কল্যাণ আসবে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব শুধু নারীদের উপর ছেড়ে দিলেই চলবে না। সংসদে আইন পাস করাই যথেষ্ট নয়, আইনের সঠিক প্রয়োগ হওয়া দরকার। সর্বোপরি, সমাজের প্রত্যেকের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করার অবিরাম প্রক্রিয়া থাকতে হবে।
বিঃদ্রঃ আমরা খ্রীষ্টানরা নারীর অধিকার,ক্ষমতায়নে বিশ্বব্যাপী সোচ্ছার।