
প্রিয়পাঠক, ট্রিনিটি সম্পর্কে শুধু যে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভূল ধারণা আছে, তা নয়, আমাদের খ্রীষ্টাদের মাঝেও এ নিয়ে যতেষ্ট ভুল ধারণা আছে, আবার পরস্পরের মাঝে মতবিরোধও আছে। পবিত্র বাইবেলের আলোকে ট্রিনিটিকে না দেখে অনেকেই নিজের জ্ঞান দিয়ে ট্রিনিটিকে বুঝা ও বুঝানোর চেষ্টা করেন। আমি মনে করি যে, ট্রিনিটি সম্পর্কে বাইবেলে কোন অসম্পূর্ণতা নেই, ট্রিনিটি না বোঝার মত কোন বিষয়ও নয়। বরং পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা সম্পর্কে আমাদের যতটুকু জানা প্রয়োজন, তা পুরোপুরিভাবেই আছে। আমরা যখন স্বর্গে যাব, তখন পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মাকে সামনা-সামনি দেখব, তখন আমাদের আর কোন প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের বোঝা অনেক দেরি হয়ে যাবে, তাই নয় কি?
তাই আসুন, এখন আমরা পবিত্র বাইবেলের ১করি ১৫:২৮ পদ মনোযোগ সহকারে পড়ি;
"আর সকলই তাঁহার বশীভূত করা হইলে পর পুত্র আপনিও তাঁহার বশীভূত হইবেন,যিনি সকলই তাঁহার বশে রাখিয়াছিলেন; যেন ঈশ্বরই সর্বেসর্বা হন।" (১করি ১৫:২৮)
বাইবেল থেকে সারাংশ করে বলা যায়, ঈশ্বর হচ্ছেন এক, ব্যক্তি, আত্না, যাঁর কোন দেহ বা আকৃতি নেই, যিনি অদৃশ্য, পবিত্র ও সিদ্ধ, অনন্তকালীন, স্ব -নির্ভর, সার্বভৌম, মানুষের সংগে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপন করার ক্ষমতাপন্ন জন যিনি নিজেকে দৃশ্যনীয় পুত্র যীশুতে প্রকাশ করেছেন, এবং অদৃশ্য পবিত্র আত্মায় প্রকাশমান। কিন্তু পৌল আমাদের বলছেন যে, পুত্র আপনিও তাঁহার বশীভূত হইবেন, এই কথার অর্থ কি? পৌল এখানে কি যীশুর ঈশ্বরত্বকে অস্বীকার করছেন? মোটেই না,তা দূরে থাকুক। বরং ১ করি ১৫ অধ্যায়ে তিনি, পুত্র ঈশ্বরের মাংসে মূর্তিমান হওয়ার উদ্দেশ্য ও কারণ, শয়তানের ধ্বংস, মৃত্যুর ও পাপের ক্ষমতাকে সমূলে লুপ্ত করে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন, হ্যা, যীশু খ্রীষ্টের প্রথম ও দ্বিতীয় আগমনে তা সম্পূর্ণ হবে।
আজ হতে প্রায়, ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ভাববাদী যিশাইয়, যীশু খ্রীষ্ট সম্পর্কে ঈশ্বরের বার্তা ঘোষণা করেন,
"কারণ একটি বালক আমাদের জন্য জন্মিয়াছেন, একটি পুত্র আমাদিগকে দত্ত হইয়াছে;আর তাঁহারই স্কন্ধের উপরে কর্তৃত্বভার থাকিবে, এবং তাঁহার নাম হইবে- ‘আশ্চর্য মন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ’।" (যিশাইয় ৯:৬)
ঈশ্বর সমগ্রমানব জাতির জন্য স্বর্গীয় সুসমাচার ঘোষণা করছেন, আর তা হচ্ছে, একটি পুত্র আমাদের জন্য দেওয়া হয়েছে!
সেইপুত্রের স্কন্ধের উপরে কতৃত্বভার থাকিবে, সেই কতৃত্বের পূর্ণ ব্যাখ্যা পৌল ১ করি ১৫:২৮ পদে উল্লেখ করেছেন। তিনি মানুষ, কেননা পাপিদের মুক্তির জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন। তিনিই সেই মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যিশাইয় ৯:৬ পদের শেষ অংশ যা আমাদের ঘোষণা করে, তিনি "বিক্রমশালী ঈশ্বর", সনাতন পিতা, শান্তিরাজ।
নতুন নিয়মে যোহন আমাদের এই পদের ব্যাখ্যা বুঝতে, যতেষ্ট সাহায্য করেছেন, তিনি সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমাদের তুলে ধরেন ও তার মাংসে মূর্তিমান হওয়ার সত্য ঘোষণা করেন, সেই সত্য হচ্ছে,
"আদিতে বাক্য ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বরের সহিত ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বর ছিলেন।" (যোহন ১:১)
যোহন ১:১৪ পদ, যীশুর ঈশ্বরত্বের বিষয়ে আমাদের মনের ও জ্ঞানের সন্দেহ দূর করতে, যতেষ্ট ভূমিকা রাখে,
"আর সেই বাক্য মাংসে মূর্তিমান হইলেন, এবং আমাদের মধ্যে প্রবাস করিলেন, আর আমরা তাঁহার মহিমা দেখিলাম, যেমন পিতা হইতে আগত একজাতের মহিমা; তিনি অনুগ্রহে ও সত্যে পূর্ণ।" (যোহন ১:১৪)
উপরোক্ত পদের আলোকে আমরা ইতিমধ্যে যীশু খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্বের বিষয় পরিস্কার হয়েছি। যীশু কে? উত্তর হচ্ছে, যীশু ঈশ্বর ও মানুষ অর্থাৎ ঈশ্বর মানব। যদি তাই, তাহলে ১ করি ১৫:২৮ পদের প্রকৃত অর্থ কি?
পৌল, এখানে যীশুর মাংসের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করছেন, "সেই পুত্র" যা ঈশ্বর আমাদের জন্য দিয়েছেন। পুত্র পিতার নিকটে এ অর্থে বশীভূত হবেন যে, প্রশাসনিকভাবে সমস্ত কিছুকে তাঁর কতৃত্বে বশীভূত করার পর, তিনি এর সবকিছুই পিতার নিকট ফিরিয়ে দিবেন, যে পিতা প্রশাসনিক কর্তা। যীশুর মানবত্ব মূল নয়, তাঁর ঈশ্বরত্বই মূল কেননা পবিত্র বাইবেল বলে,
"কারণ খ্রীষ্টও একবার পাপসমূহের জন্য দুঃখভোগ করিয়াছিলেন- সেই ধার্মিক ব্যক্তি অধার্মিকদের নিমিত্ত- যেন আমাদিগকে ঈশ্বরের নিকট লইয়া যান। তিনি মাংসে হত, কিন্তু আত্মায় জীবিত হইলেন।"(১ পিতর ৩:১৮)
যীশু মাংসে হত কিন্তু আত্মায় জীবিত এই কথার অর্থ যীশুর ঈশ্বরত্ব অনন্তকালীন। ট্রিনিটির তিন ব্যক্তির সকলে ঈশ্বরত্বে ও মর্যাদায় সমান। যে অধীনস্থতার কথা এখানে বলা হচ্ছে তা কাজের একটিকে বুঝাচ্ছে। ট্রিনিটিতে পিতা সর্বোচ্চ; পুত্র পিতার ইচ্ছা পালন করেন, উদাহরণস্বরুপ সৃষ্টিতে, উদ্ধারে, আর আত্মাকে পাঠানো হয়েছে পিতা ও পুত্র কতৃক জীবনকে প্রাণবন্ত করতে, ঈশ্বরের সত্য প্রকাশ করতে, লোকদের প্রতি মুক্তির বার্তা প্রয়োগ করতে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনে তাদের সক্ষম করতে। যেন ঈশ্বরই সর্বেসর্বা হন। ত্রিত্ব ঈশ্বরকে সমস্ত বিষয়ে সার্বভৌম বলে দেখানো হবে। যীশুর পূর্ণ বিজয় কোনই অর্থে পিতার শাসনের সাথে প্রতিযোগিতায় নয়, যাঁর প্রতি পুত্র বাধ্য, যোহন ৬:৩৮ ও ইব্রীয় ১০:৭। এর লক্ষ্য হচ্ছে যেন, ঈশ্বরই সর্বেসর্বা হন, রোমীয় ১১:৩৬। এর অর্থ এই নয় যে, ঈশ্বর সব কিছু আত্তীকৃত হবে, কিন্তু তাঁর সকল সৃষ্টির উপরে প্রেমময় ঈশ্বর সিদ্ধভাবে স্বীকৃত শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। যীশুর বিশেষ সার্বভৌমত্বের অনুশীলন শেষ শক্রুকে পরাজয়ে শেষ হয়, এবং তিনি পিতার নিকট রিপোর্ট করতে পারেন যে তাঁর কাজ সমাপ্ত।
পবিত্র বাইবেলের ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় কিন্তু তিন ব্যক্তিতে প্রকাশিত। ঈশ্বর সর্বেসর্বা এই কথার মধ্যে ট্রিনিটি ঈশ্বরত্বের ঘোষণা বিদ্যামান, পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর ও পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। ঈশ্বর সর্বেসর্বা পৌলের এই কথার দ্বারা যীশুর খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে না বরং যীশু খ্রীষ্টের ঈশ্বরত্বকে স্বপরাক্রমে ঘোষণা করা হচ্ছে। কেননা যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বর এটি আমাদের স্বীকারের উপর নির্ভরশীল নয়, আমরা স্বীকার করলেও তিনি ঈশ্বর আমরা অস্বীকার করলেও তিনি ঈশ্বর।
Comments